নবুওয়তী আদব তথা ইসলামী শিষ্টাচার মানব জাতির জন্য এমন কিছু ধারাবাহিক প্রজন্ম উপহার দিয়েছে, যারা সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কুলুষতা, পবিত্রতা, আদল ইনসাফ, ব্যক্তিত্ব, লজ্জাশীলতা, দয়া দাক্ষিণ্য এবং শক্তি-সামর্থ ও বীরত্বে ছিলেন অতুলনীয়

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা

শ্রমিকেরা উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যম, যারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তাই শ্রমিকদেরকে উৎপাদনের সবচেয়ে অগ্রগন্য চালক বলা যেতে পারে। শ্রমিকদের উৎপাদন ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল কেননা আমরা প্রতিদিন যে থালা-বাসনে খায়, রংবেরংয়ের পোশাক পরি এমনকি আমরা যে ঘরে বাস করি সব কিছু শ্রমিকদের কষ্টের ফসল। পৃথিবীর শুরু থেকে আমরা দুই শ্রেণীর লোক দেখতে পাই: পুঁজিপতি ও শ্রমিকশ্রেণী, যাদের মধ্যে চিরন্তণ দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সম্পদের অসম বন্টন, শ্রমিকদের সাথে খারাপ ব্যবহার এবং মাঝেমাঝে শ্রমিকরা মালিকের অবাধ্য হওয়া। আর এ কারণে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাহ্যত হয়।

মধ্য যুগে কাজের সময় নির্ধারণ ও সঠিক মজুরি নির্ধারণের জন্য ইংল্যান্ডে শ্রমিকেরা বিদ্রোহী করে। ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে একটি আইন পাশ করা হয় যে ৯ বছরের কম বয়সী শিশুকে কাজে লাগানো যাবে না, ৯-১৩ বছর বযসী শিশু দিনে ৮ ঘন্টা এবং ১৪-১৮ বছর বযসী দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করতে পারবে।

বর্তমান শ্রমিক অধিকারের ধারণাটি উনবিংশ শতাব্দীতে লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলে আসে। এরপর শ্রমিক অধিকার রক্ষার নিমিত্তে ১৯১৯ সালে The International Labour Organization [ILO] প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত the United Nations Declaration of Human Rights এর ২৩ ও ২৪ নং আর্টিকেলে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা আছে। সেখানে প্রত্যেকের পছন্দমত কাজ করার অধিকার, বিশ্রাম নেওয়া, বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং শ্রমিকের ন্যয্য পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা ছুটি ভোগ করতে পরবে ও তাদের স্বার্থে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং অংশগ্রহণ করতে পরবে।

শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার কয়েকশ বছর পূর্বেই ইসলাম শ্রমিকদের মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম একমাত্র ধর্ম বা আদর্শ যা শ্রমিক ও ধণিকশ্রেণীর অধিকার নির্দিষ্ট করেছে। মানুষের হালাল উপায়ে অর্জিত সকল প্রকার কাজকে ইসলাম অনুমোদন করেছে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক পথে অর্থাপোর্জন শুধু দায়িত্ব নয় বরং একটি মহৎ গুনও। পবিত্র কুরআন ও হাদীস শ্রমিক ও ধণিকশ্রেণীর অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছে এবং শ্রমিকের সাথে কি ব্যবহার করতে হবে তার দিক নির্দেশনা ও দিয়েছে। কুরআন ও হাদীসে মালিক ও শ্রমিকেরর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে।

ক. মালিক শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক পুরোপুরি পরিশোধ করবে এবং
খ. শ্রমিক বিশ্বস্ততার সাথে মালিকের কাজ সম্পন্ন করবে।

পবিত্র কুরআনে কাজ বা শ্রম দেওয়াকে আমল [Amal] বলা হয়েছে। যা ৩৬০ টি আয়াতে উল্লেখ আছে। এ ছাড়া ফিল [Fil] শব্দটি ও ১০৯ টি আয়াতে উল্লেখ আছে। এর দ্বারা আমরা কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারি। যদিও সব শব্দ গুলো কাজ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। নামাজের পরেই মানুষকে খাদ্য অন্বেষণের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে [সুরা জুমআ]। হাদীসে নিজের পরিবারের জন্য আয় করাকে সর্বোত্তম সদকাহ বলা হয়েছে। শারীরীক ও মানসিক ভাবে সক্ষম ব্যক্তিকে কাজ করার জন্য ইসলামে তাগিদ দিয়েছে। কাজ করা শুধু অধিকার নয় বরং এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব। তবে কে কি কাজ করবে এটা ব্যক্তির উপর নির্ভর করবে।

মানব ইতিহাসে দাসদের অবস্থা খুবই করুন। প্রাচীনকালে দাসরা অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হত এবং মানুষ হিসাবে নুন্যতম যে মর্যাদা তা ও পেতনা। পশুর ন্যায় তাদের সাথে ব্যবহার করা হত। কিন্তু ইসলাম অন্য ধর্ম ও সভ্যতা হতে একেবারে বিপরীত। বরং যে ব্যক্তি দাসকে মুক্ত করবে তার জন্য পাপ ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কথা বলা হয়েছে। রাসুল সা: নিজে ৬৩ জনের বেশি দাস মুক্তি দিয়েছিল। হযরত আয়েসা রা: ৬৭ জন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ৭০ জন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ১০০০ জন এবং আব্দুর রহমান ৩০০০ জন দাস ক্রয় করে মুক্ত করে দেয়।

রাসুল সা: বলেছেন দাসরা তোমাদের ভাই, যাদেরকে তোমাদের অধিনস্ত করা হয়েছে। তাই তোমরা যা খাও তাদেরকে তা খাইতে দাও, তোমরা যা পর তাদেরকে তা পরতে দাও। তাদের উপর কষ্টদায়ক কাজ চাপিয়ে দিওনা। আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত যে রাসুল স: বলেছেন,আল্লাহ বলেন তিন ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দাস রাখে এবং তার দিয়ে কাজ করিয়ে নেয় কিন্তু পারিশ্রমিক দেয়না।

ইবনে মাজাহতে বর্ণিত আছে রাসুল স: বলেছেন-তোমরা শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দিবে। রাসুল সা: আরো বলেছেন শ্রমিকের জন্য যা সহজ, মালিকের সে কাজ করিয়ে নেওয়া উচিত। আর শ্রমিকের স্বাস্থ্যের জন্য যে কাজ ক্ষতিকর তা না করানো উচিত। তিনি আরো বলেন সে মুমিন নয় যে পেট ভরে খায় কিন্তু তার প্রতিবেশি অভুক্ত থাকে।

ইসলাম শ্রমিকদের বিশ্বস্থতা, সততা এবং সতর্কতার সাথে কাজ করার কথা বলেছে। রাসুল সা: তার মৃত্যূর শেষ মূহুর্তে বলেন তোমরা দৈনিক প্রার্থণা ঠিকভাবে পালন করবে এবং তোমাদের অধিনস্থদের অধিকার পুরুন করবে। ইসলাম নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে।

প্রতিদান :

শ্রমিকের কাজের বিনিময় তাকে তার প্রাপ্য দেওয়ার জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বুখারী শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি শ্রমিকের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নিবে কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করবে না, কিয়ামতের দিন আল্লাহ নিজেই ঐ মালিককে জিজ্ঞাসা করবে।

বিশ্রাম :

শ্রমিকদের সক্ষমের বাইরে কাজ দেওয়া উচিত নয়। তাদের শারীরীক ও মানসিক বিশ্রামের অধিকার আছে। রাসুল সা: শরীরের বিশ্রামের কথা ও বলেছে। তিনি বলেন তোমার উপর তোমার শরীর ও পরিবারের অধিকার আছে [বুখারী]। তিনি শ্রমিককে ছোট মনে করতে নিষেধ করেন বরং তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করতে আদেশ দেয়।

ভর্তুকি প্রদান :

রাসুল স: বলেছেন- শ্রমিকেরা তোমাদের ভাই, যাদের উপর আল্লাহ তোমাদের অভিভাবকত্ব দিয়েছে। তাই তোমার কোন ভাই যদি তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন তোমরা যা খাবে সেটা থেকে তাদেরকে দিবে, তোমরা যা পরিধান করবে তার ও তাই পরিধান করতে দিবে। আর তারা যা বহন করতে পারবে না, তা তাদের উপর চাপিয়ে দিবে না। যদি তা কর তবে তাদের কঠিন কাজে সহযেগিতা কর। [বুখারী]

আমরা প্রতিদিন পত্রিকাতে বাসার কাজের মেয়ে বা শ্রমিকদের উপর মালিকের অমানসিক ও অমানবিক নির্যাতনের কাহিনী পড়ি। এ সমস্ত ঘটনা আমাদের কারো বিবেককে নাড়া দেয় আবার কারো কাছে কোন ঘটনাই মনে হয় না। আমরা কোন দিন ভাবিনা যে তারা ও মানুষ। আমরা যেমন নিজের পরিবারের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য কষ্ট করে উপার্জন করি, আপনার বাসায় কাজ করা ঐ নিষ্পাপ শিশুটি তার পরিবারের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য বকুনি খাওয়া, খাওয়ার কষ্ট এবং নির্যাতন সব কিছু নিরবে সহ্য করে। আমরা কি পারি না তাদের উপর সদয় হতে এবং তাদের বেতন একটু বাড়িয়ে দিতে? আসুন ইসলামের আলোকে আমাদের শ্রমিক ও বাসার কাজের শিশুদের সাথে ব্যবহার করি এবং তাদের কষ্টকে লাঘব করে দেই।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Masudwrcdu@yahoo.com ( সংগৃহিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন