নবুওয়তী আদব তথা ইসলামী শিষ্টাচার মানব জাতির জন্য এমন কিছু ধারাবাহিক প্রজন্ম উপহার দিয়েছে, যারা সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কুলুষতা, পবিত্রতা, আদল ইনসাফ, ব্যক্তিত্ব, লজ্জাশীলতা, দয়া দাক্ষিণ্য এবং শক্তি-সামর্থ ও বীরত্বে ছিলেন অতুলনীয়

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

ইসলামে কন্যা শিশুর অধিকার

ইসলাম ধর্ম মতে, কন্যাশিশু ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য বেহেশতের শুভবার্তা বয়ে আনে এবং সংসারজীবনকে স্নিগ্ধ মায়া-মমতায় ভরে রাখে। এরা ঘরের সৌন্দর্য, ঘরকে আলোময় করে তোলে। কিন্তু বর্তমান সমাজে অনেকেই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে খুবই বিব্রতবোধ করেন। একাধিক কন্যা হলে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে বিভিন্ন রকম অমানুষিক নির্যাতন করে থাকে।
এমনকি তালাক দেওয়ার মতো নির্মম ও অত্যন্ত জঘন্য পথেও পা বাড়ায়। নানাভাবে তাকে নিগৃহীত করা হয়। নির্মম ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বব্যবস্থায় বিরাজমান বাস্তবতা কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষার পক্ষে মোটেই অনুকূলে নয়। অথচ কন্যাসন্তান প্রতিপালনে রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষকে উদাত্তকণ্ঠে আহবান জানিয়েছেন। অসংখ্য হাদিসে কন্যাশিশু প্রতিপালনের মর্যাদা ও অশেষ পুণ্যের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) পিতার অন্তরে কন্যাসন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে যে ব্যক্তি দুটি কন্যাসন্তানকে বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি ও সে এরূপ কাছাকাছি থাকব বলে তাঁর আঙুলগুলো মিলিয়ে দেখান। (মুসলিম)।
ইসলাম কন্যাশিশুকে সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে ঘোষণা করেছে এবং যাবতীয় বৈষম্যমূলক অশোভনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিটি শিশুসন্তান পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ও বিকশিত হওয়ার অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পুত্রসন্তানের মতো কন্যাশিশুরাও এ অধিকারের সমান দাবিদার। প্রাক-ইসলামী অন্ধকার যুগের হীন মনোবৃত্তির কথা মহান আল্লাহ মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয় তার গ্লানি হেতু সে নিজ সমপ্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে ভাবে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে! সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কতই না নিকৃষ্ট। (সুরা আন-নাহল,
আয়াত: ৫৮-৫৯)।
পুত্র কিংবা কন্যাকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সমান অধিকার ও সুযোগ পেলে কন্যারাও সমাজে নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ইসলাম মানুষকে এ ধারণায় দীক্ষিত করেছে যে, পুত্র-কন্যা দুই ধরনের সন্তানই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিশেষ উপহার। সন্তানকে চোখ জুড়ানো সম্পদ বিবেচনা করে পুত্র বা কন্যা হোক আচরণের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করে না। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সাধারণত পুত্রসন্তানের প্রতি অধিক যত্ন নেওয়া হয়। বৃহত্তর সমাজ তো দূরের কথা, পরিবারেই কন্যাশিশুটি সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়। এটি আমাদের জরাজীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার মারাত্মক ত্রুটি। ইসলামের সুমহান বাণী তাদের বোধ-বিশ্বাসে সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান করে নিতে পারেনি। অথচ মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, তোমাদের সন্তানদের মধ্যে কন্যাই উত্তম। (মুসলিম)।
দরিদ্র পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে কন্যার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ছেলের লেখাপড়া কষ্টে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ কিশোরীটিও যে পরিবারে শ্রম ও মেধা দিয়ে সাহায্য করে,
তার হিসেব কেউ রাখে না। তারা মেধাবী নয়, সৃষ্টিশীল নয়, এমন অজুহাতে অনেক সময়ই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও  পরিবার তাদের প্রাপ্ত  সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। সংসারে মেয়েদের কাজকে স্বীকৃতি দেয়া
হয় না। তার কাজের যে আর্থিকমূল্য আছে তা বিবেচনায় নেয়া হয় না। কন্যাশিশুকে তার সমবয়সী একজন পুত্রসন্তানের মতো একইভাবে আদর-যত্ন দিয়ে লালন-পালনের প্রতি সব মা-বাবারই আরো সচেষ্ট ও সচেতন হতে হবে; তা না হলে এর প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর পড়বে। তাই কন্যাশিশুর প্রতি কোনো রকম তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, পুত্র ও কন্যার মধ্যে পার্থক্য বিধান এবং মেয়েদের ওপর ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্য দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন নবী করিম (সা.)।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয়, বিয়েই হচ্ছে কন্যাশিশুদের একমাত্র গন্তব্যস‘ল। তাই প্রয়োজনে শিক্ষাকে ব্যাহত করেও নির্দিষ্ট বয়সের আগেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। আর্থিক কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হলে কন্যাশিশুর ভাগ্যেই তা জোটে। এখনো অনেক পরিবারে কন্যাশিশুকে প্রয়োজনীয় বা ছেলে শিশুর আনুপাতিক হারে খাবার খেতে দেওয়া হয় না। কন্যাশিশুর অসুস্থাতাকেও অনেক পরিবারে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। খাবারের উৎকৃষ্ট অংশ, যেমন মাছের মুড়োটা, কন্যাকে না দিয়ে পুত্রকে দেয়া যেন সমাজের রীতি। অথচ কিশোরীর স্বাস্থ্য ভাল রাখতে হলে সঠিক ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রয়োজন। খাবারদাবার সম্পর্কিত কুসংস্কার দূর করা প্রয়োজন। কিন্তু  প্রচলিত নীতিকথা আর চিন্তাচেতনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি অনেকেই।
মহানবী (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) এর সঙ্গে যে ধরনের উঁচুমানের ব্যবহার করতেন, তা ছিল তৎকালীন সমাজের নিয়মকানুনবহির্ভূত। তিনি কন্যাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, যেখানে যেতেন শিশু ফাতেমাকে সঙ্গে নিয়ে বলতেন তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার প্রথম
সন্তান মেয়ে।
আজকের কন্যাশিশুই আগামী দিনের একজন নারী, আগামী দিনের মা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়ামক শক্তি। অথচ বঞ্চনার কারণে কন্যাশিশুরা পরিণত বয়সে ছেলেদের মতো মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারছে না। এভাবে কন্যাশিশুকে অধিকারবঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যের সূত্রপাত হয় তার খেসারত শুধু কন্যাশিশু আর নারী নয়, গোটা জাতিকে দিতে হয়। এ কঠিন বাস্তবতায় ইসলামে কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষা ও বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া প্রয়োজন। কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য, অবহেলা, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এখনই। এজন্য সরকার ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে শিক্ষাভাতা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনাবেতনে অধ্যয়ন সুবিধা, বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নারী অধিকার রক্ষা ও নারীর প্রতি সহিংসতারোধে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কর্মসূচিগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে এদেশে কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসূত্র: সময়২৪.কম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন